বাঘা তেঁতুলের গল্প
-দীপালী পাল
(অনেক পুরনো একটা সত্যি ঘটনা অবলম্বনে লেখা)
ছোটবেলা থেকেই খুব দুষ্টু তেঁতুল,ঠাকুমা সাধ করে নাম রেখেছিলেন তেঁতুল।সেই নামটাই এখনও রয়ে গেছে কিন্তু গ্ৰামের স্কুলে ভর্তির সময় অবশ্য “সমীরন দে” নামেই ভর্তি করা হয়েছিল। তেঁতুলের বাড়ি সুন্দর বনের গোসাবা থানার পাখিরালয় গ্ৰামে।যেমন উঁচু লম্বা তেমন মোটাসোটা দেখতে,সাদাসিধে স্বভাবের জন্য গ্ৰামের আট থেকে আশি সবাই তাকে ভালবাসতো।ওদের বাড়ির কিছুদূরেই ভীষণ জঙ্গল, আর জঙ্গলের ওধারে নদী ছিল। খানিকটা দূরে দূরে চার পাঁচটা বাড়ি আবার কিছুটা ঝোপঝাড় ও জঙ্গল,তারই মধ্যে দিয়ে মাটির রাস্তা চলে গেছে একেবারে শহরের বাজার পর্যন্ত।
তেঁতুল ভালো মন্দ খেতেও খুব ভালবাসতো। হাফ কেজি মুরগির মাংস একা একবারে খেয়ে ফেলতে পারতো, গায়ে খুব শক্তি ,কারোর হাত মুচড়ে ধরলে সে আর ছাড়িয়ে যেতে পারতোনা। সে পঁয়ত্রিশ বছরের যুবক,গ্ৰামে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে সদ্য স্বাস্থ্যকর্মীর চাকরী পেয়েছে।
বাড়ি থেকে প্রায় ত্রিশ কিলোমিটার সাইকেল চেপে সকালে যায় আর সন্ধ্যেতে বাড়ি ফেরে। বাড়িতে বাবা মা কেউ বেঁচে নেই ,আছেন খালি এক বিধবা পিসিমা ,পিসিমা সাবিত্রীই রোজ রান্না বান্না করেন,মা বাবা মরা ছেলেটাকে সেই দশ বছর বয়স থেকে পিসিমাই মানুষ করেছেন। কিন্তু তেঁতুলের বিরাট চেহারার কারণে এখনও বিয়ে হয়নি , তার গায়ের রংটা মিশমিশে কালো , আর অনেকটা উঁচু লম্বা চেহারা বলেই তার কখনও বিয়ের সম্বন্ধ আসেনি আর তেঁতুল ও গ্ৰামের মেয়েদেরকে এড়িয়ে চলাই পছন্দ করতো । খেতে খেতে একদিন পিসিমা বললেন “ওরে ও তেঁতুল বলি পঁয়তিরিশ বচ্চরের হইয়ে গেইলি এইবার ঘরেতে একটা সোন্দর বউমা নে আয়,আর কতো দিরি করবি রে বাপ”
তেঁতুল ভাতের গ্ৰাস মুখে দিয়ে পিসিমাকে বোললো”আমার কোনো মেয়েকে পছন্দ হয়না,তুমি তো জানো বরং তুমি কাউকে পছন্দ করো পিসিমা”
“আমি করবো,ঠিক আছে বাপু , খোঁজ খপর নিতি হবে”
তেঁতুল সাধারনত রোজ সন্ধ্যে বেলা বাড়িতে ফেরে, কিন্তু একদিন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে একটা অসুস্থ লোককে নিয়ে সোরগোল পড়ে গেল, এক ডাক্তার বাবুর জন্য ওষুধ আনতে অনেক দূরে গিয়েছিল সে। রাত প্রায় বারোটা বেজে গিয়েছিল,এদিকে পিসিমা তো ছেলেটা ফিরছে না কেনো সেই চিন্তায় মাটির দাওয়ায় মুখে হাত দিয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে বসে থাকলেন। পাশের বাড়ির নিধিরামকে ডেকে তেঁতুলকে ফোন করার কথা বললেন, তারপর জানা গেল যে তার আসতে বেশ রাত হবে। এ এলাকায় বেশী রাত হলে বাঘের ভয়ে কেউ বাইরে বেরোয়না। পিসিমা ফোনে ভয়ার্ত কন্ঠে বললেন”সাপধানে,তাড়াতাড়ি আসিস বাপ,”
তেঁতুলের কাজকর্ম শেষ হল যখন তখন রাত প্রায় দেড়টা হবে, এদিকে অদম্য সাহসী তেঁতুল ম্যানগ্ৰোভ অরন্যের পাশ দিয়ে ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে সাইকেলের প্যাডেলটা বেশ জোর দিয়ে চালাতে লাগলো,শুনশান রাস্তা , দূরে পূর্ণিমার চাঁদের আলোয় রাস্তা ঘাট সবকিছু পরিস্কার দেখা যাচ্ছে। তার মধ্যে কিছুক্ষণ আগে এক পশলা বৃষ্টি এসে রাস্তাটা একেবারে ভিজিয়ে দিয়ে গেছে ,হঠাৎ খপাৎ করে লোমশ বিরাট একটা জন্তু তার গায়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল ,তার ঘাড় কামড়ানোর চেষ্টা কোরলো,তেঁতুল মুহুর্তের মধ্যে বুঝতে পারলো তাকে বাঘ আক্রমণ করেছে, কিংকর্তববিম্যূঢ় হয়ে সে তাড়াতাড়ি বাঘের পা সজোরে চেপে ধরে এমন জোরে কামড়ে ধরলো ,যে বাঘটা তাকে মুহুর্তের জন্য ছেড়ে দিতে বাধ্য হল তেঁতুল ও মাটিতে শক্ত হয়ে দাড়িয়ে সাইকেল টাকে বাঘের উপর ঘোরাতে লাগলো। বিশালকায় তেঁতুলকে আবার বাঘ ধরল এবার তেঁতুল বাঘকে প্রচন্ড ঘুষি মারতে লাগলো, ক্ষতবিক্ষত হয়েও তেঁতুল বাঘের সাথে যুদ্ধ করতে লাগলো আর “বাঘ” “বাঘ” বলে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতেই থাকলো এরমধ্যে ঐ গ্ৰামের কতকগুলো লোক চিৎকার শুনে বুঝে গেল কেউ নিশ্চই বিপদে পড়েছে তারা লাঠি আর মশাল নিয়ে রা রা করতে করতে চলে এলো,ভয় পেয়ে বাঘটা দৌড়ে নিমেষের মধ্যে তেঁতুলকে ছেড়ে দিয়ে কোথায় যেন পালিয়ে গেল। সবাই তেঁতুলকে গ্ৰামের এক ডাক্তার বাবুর বাড়িতে নিয়ে গেল,চিৎকার চেঁচামেচিতে ঘুমন্ত গ্ৰাম একেবারে জেগে উঠল। সবাই তেঁতুলকে বোললো “অন্য কেউ হলে এতোক্ষণে বাঘের পেটে হজম হয়ে যেতো তেঁতুলদা তুমি বলেই বাঘটার সাথে লড়াই করে বেঁচে এসেছো,তুমি সত্যি বীর পুরুষ ,বাব্বা তুমি কি সাহসী !!তুমি যে বেঁচে গেছো সেটাই বড় কথা”
এরপর তেঁতুলের সাহসী মানসিকতার কথা সারা গ্ৰামে ছড়িয়ে পড়ল লোকে তাকে নাম দিল “বাঘা তেঁতুল”।
পিসিমার চিন্তা হল তেঁতুলের ক্ষতগুলো নিয়ে ,কবে সারবে কে জানে এই চিন্তাই করতে লাগলেন। মাসখানেক ধরে পিসিমার সেবা যত্নে তেঁতুল সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠলো।
পঞ্চায়েতের প্রধান হরিহর বাবু তেঁতুলের সাহসিকতায় আপ্লুত হয়ে তার একমাত্র বিবাহ যোগ্যা মেয়ের সঙ্গে তেঁতুলের বিয়ে দেবার কথা ভাবলেন ।
একদিন হঠাৎ হরিহর বাবু তেঁতুলের বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে তেঁতুলের পিসিমার কাছে হাজির হলেন। পিসিমা বললেন “তেঁতুল বাড়ি আসলি আমি বইলবো আর ওর মতামত পালি আপনারে জানায় দেবো”। তার বিয়ের যোগ্য সুন্দরী গুণবতী মেয়েকে চেনে পাড়ার সকলে।
তেঁতুল বাড়ি আসতেই পিসিমা তেঁতুলকে বলল “ওরে মোর বাঘা তেঁতুল তোর জন্যি একটা টুকটুকে বউ নিয়ে আসবো এইবারে”
তেঁতুল মাথা নিচু করে বলল
“তুমি যা বলবে তাই হবে পিসিমা,কিন্তু সে কে জানতে পারি?”
“দোলা,পঞ্চায়েতের পেধ্যান হরিহর বাবুর মেইয়ে”
“আমি চিনি ওকে,তুমি কথা দিয়ে দিয়েছ”
পিসিমা ইচ্ছে করেই বললেন–
“হ্যা,”
তেঁতুলের ঠোঁটের কোনায় মুচকি হাসি দেখা গেল আর বলল”তুমি যা করবে সেটাই হবে ,পিসিমা।”
বেশ ভালো লাগলো